দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নয় জামায়াতে ইসলামী। ইস্যুকেন্দ্রিক
গণমাধ্যমে কিছু বিবৃতি পাঠানো; আর মাঝেমধ্যে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল করা
ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই বললেই চলে। এই অস্বাভাবিক নীরবতায়
দলটির রাজনীতি কার্যত শেষ হয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে বাস্তবতা বলছে
ভিন্ন কথা। সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের পথে হাঁটা বিএনপিসহ
রাজপথের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে নিজেদের সক্রিয় করতেও
প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। এ লক্ষ্যে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা
দলটি উপরে নীরব থাকলেও গোপনে বিভিন্ন অভিনব কৌশলে চলছে তাদের সাংগঠনিক
শক্তি সঞ্চয়ের কাজ। ভিন্ন কৌশলে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। (খবর- ভোরের কাগজ)
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সারাদেশে জামায়াতের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া ২০১৩ ও ২০১৫ সালে আগুন সন্ত্রাসের মামলায় দলটির নেতাকর্মীদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। মোকাবিলা করতে হচ্ছে অসংখ্য মামলা। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশকে ম্যানেজ করে রাজনীতির মাঠে ফিরছেন একাধিক মামলা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েকশ নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন গোপন বৈঠককালে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে জামায়াত-শিবির : প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ না করে ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে অনলাইনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। জানা গেছে, সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে- হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মীদের সঙ্গে সাংগঠনিক যোগাযোগ রাখছেন নেতারা। সুযোগ পেলেই তারা বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। অনলাইন লাইব্রেরির মাধ্যমে সংগঠনের আদর্শ প্রচার করছেন।
কৌশলে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনীতির মাঠে ‘সুসংগঠিত’ দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে চুপ থাকার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। মাঠের রাজনীতি অনুক‚লে না থাকায়
নেতাকর্মীদের মন এখন দল গোছানোর দিকে। কেন্দ্রের নির্দেশনা মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বদলে নানা কৌশলে সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ভেতরে ভেতরে সারাদেশে কাজ চলছে দলের। আগে গোপনে বৈঠক করার যে ধারাটি ছিল, সেটিও এখন আর সেভাবে হচ্ছে না। তবে আগের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে না পারলেও বসে নেই দলটির নেতাকর্মীরা। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র থেকে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়েও ভিন্ন কৌশলে চালানো হচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। কখনো কখনো সবার কাছে দলীয় সিদ্ধান্ত পৌঁছে যাচ্ছে ব্যক্তিগত আলাপে। কখনো আবার আড্ডার ফাঁকে সেরে নেয়া হয় সাংগঠনিক আলাপ।
ভোরের কাগজকে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের বর্তমান সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দেন। ওই নেতা বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে, (তার ভাষায়) আমাদের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। এর আগে আমরা রাজনীতির ময়দানে এতটা অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হয়নি।
তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় কোথাও বসতে পারছি না। জড়ো হতে পারছি না। তাই বলে তো দলের কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। পার্কে হাঁটার সময় অথবা আড্ডার ছলে কিছু নেতাকর্মী (সাবধানতা অবলম্বন করে) জড়ো হয়ে দলের সাংগঠনিক তথ্য আদান-প্রদান করছি। বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে অংশ নিয়ে দলের নির্দেশনা নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
ঠিক একইভাবে নেতাকর্মীদের বিয়ের অনুষ্ঠানেও বাদ যাচ্ছে না তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম। নেতাকর্মীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের দায়িত্বশীলরা উপস্থিত হচ্ছেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক আলাপ সেরে নিচ্ছেন। আত্মগোপনে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারাও নানা কৌশলে বিভিন্ন স্থান সফর করছেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
এসব কমিটিতে বাছাই করা তরুণ নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সারাদেশে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দলের গুরুত্বপূর্ণ শাখা কমিটিগুলোতেও তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ লক্ষ্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে সাংগঠনিক মূল কাজ তথা দাওয়াতি কাজের দিকে বেশি জোর দিচ্ছে দলটি। পাশাপাশি চলছে অন্যান্য কার্যক্রমও।
এদিকে সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। জানা গেছে, জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে ভোল পাল্টে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করছেন। নিবন্ধন বাতিল হলেও তাদের অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জামায়াত-শিবিরের আর্থিক সরবরাহ অব্যাহত আছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, নিজেদের সংগঠিত করতে বিকল্প পন্থা হিসেবে তাদের পরিচালিত আর্থিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে বৈঠক করে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। গত কয়েক বছর তারা প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করার পরিবর্তে সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মাদ্রাসা, মসজিদ ও ঘরোয়া বৈঠক করে দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করছেন। কৌশলের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যেও নিজেদের সংগঠিত করছেন।
শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে না এসে সাথী ও সমর্থকদের দিয়ে সংগঠন গোছানোর কাজ করছেন। জামায়াতের শীর্ষ পদের নেতারা জামায়াতের কথা সরাসরি উল্লেখ না করে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ, বিশিষ্ট সমাজসেবক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উল্লেখ করছেন। শুধু তাই নয়, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী কিংবা সমর্থকরা ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় স্বার্থান্বেষী নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের প্রভাব বলয় তৈরি করছেন। তারা কৌশল হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থনেও কথা বলছেন। জামায়াত-শিবির নিজেদের নিরাপদ রাখতে এবং নির্বিঘ্নে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতেই এ কৌশল বেছে নিয়েছে।
বিভিন্ন সময় গোপন ঘরোয়া বৈঠক থেকে নাশকতার পরিকল্পনার সময় পুলিশ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ তাদের ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে দেখে, তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ ভাগ যুবকের ফেসবুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তাদের ছবি আছে। ফেসবুকে অনেকেই নিজেদের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দাবি করছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে তারা সাংগঠনিক সম্মেলন পর্যন্ত করেছেন।
ঘরোয়া বৈঠকগুলোর খবরও তারা দেন ‘টেলিগ্রামে’র (নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গ্রুপ) মাধ্যমে। চেতনা-৭১, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ- এ ধরনের বিভিন্ন নামে তারা ফেসবুক গ্রুপ-উপগ্রুপ তৈরি করেন। সেই গ্রুপের মাধ্যমে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নজর এড়িয়ে নিজেরা যোগাযোগ করেন।
জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠের রাজনীতিতে নীরব থাকলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রয়েছে তাদের। দেশে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজপথের সব বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের চেষ্টা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে রাজপথে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নতুন কোনো ‘কৌশল’ ও ‘কর্মসূচিতে’ বৃহত্তর ঐক্য হলে তাতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকায় থাকবে জামায়াত।
জামায়াতের নেতারা বলছেন, জামায়াত-বিএনপিসহ বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য একই- এই সরকারের পতন। এ লক্ষ্যে রাজপথে বড় আন্দোলন গড়তে বিরোধী জোট যদি আরো বিস্তৃত হয়, কিংবা ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিষ্ক্রিয় রেখে সবাই যার যার মতো করে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে সমর্থন থাকবে জামায়াতের। অর্থাৎ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলোর যে কোনো ‘কৌশল’ ও ‘কর্মসূচি’ গ্রহণে তারা নীতিগতভাবে একমত।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য বলেন, আমাদের ৮০ থেকে ৯০ ভাগই অভ্যন্তরীণ কাজ। অর্থাৎ সাংগঠনিক কাজ বা সংগঠন বিস্তৃত করার কাজ। এ কারণে দেশে যখন রাজনীতি থাকে না, তখনো আমাদের সাংগঠনিক কাজ করতে সমস্যা হয় না। এখন আমরা গ্রামভিত্তিক কমিটিগুলো শক্তিশালীকরণে কাজ করছি। যুগপৎ আন্দোলন হবে বলছেন, আপনারা কীভাবে সেই আন্দোলনে অংশ নেবেন- এমন প্রশ্নে ওই নেতা বলেন, একটি বড় আন্দোলন হবে, এটি নিশ্চিত।
তবে কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে হবে, তা কৌশলগত বিষয়। ২০-দলীয় জোটও আরো বড় হতে পারে, সবাই রাজপথে থেকে যুগপৎ আন্দোলন করবে, সেটাও হতে পারে। জামায়াত দল হিসেবে যে কোনো কর্মসূচি ও কৌশল গ্রহণে প্রস্তুত।