রিঙ্কু মজুমদার নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গত ৯ বছর ধরে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি। ভারতে বসবাস করলেও মাস শেষে তার সই করা চেকে দেশ থেকে বেতন তোলেন রিঙ্কুর স্বজনরা। তবে উপজেলা শিক্ষা অফিসের সাথে সখ্যতায় কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন মর্মে মাসিক রিপোর্টও জমা নিয়মিত। এনিয়ে দ্বীপ এলাকায় চাঞ্চচল্যের সৃষ্টি হয়।
দ্বীপের ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৫০জন শিক্ষার্থীকে নিয়মিত পাঠদান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চারজন শিক্ষককে। এত বড় অনিয়ম নিয়ে এলাকাবাসী ফুঁসে উঠায় গত ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে তার বেতন বন্ধ হয়ে যায়।
রিঙ্কু মজুমদার উপজেলার উত্তর চরঈশ্বর দাসপাড়া এলাকার সাবেক সহকারী শিক্ষক বারেন্দ্র দাসের স্ত্রী।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং অভিভাবক চয়ন দাস, শোভা রানী, মল্লিকা দাস, নিশান বাবু, পাপন দাস ও অসীম দাসসহ অনেকে জানান, গত ৮/৯ বছর পর্যন্ত চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে বসবাস করেন। তিনি ৫/৬ মাস পর পর দেশে আসেন এবং ব্যাংক তার বেতন উত্তোলনের চেকে সই করে যান। পরবর্তীতে তার স্বজনরা তার সই করা চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে বেতন উত্তোলন করে ভারত পাঠিয়ে দেন।
রিঙ্কু মজুমদারের এ অনিয়মের ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসে জানালেও কোন ব্যবস্থা নেননি শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা। কারণ তাদের সাথে সখ্যতা রেখেই এমন অনিয়ম করে যাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদার।
স্থানীয়রা জানান, সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার ভবরঞ্জন বাবু চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদারের ভগ্নিপতি ছিলেন। যার কারণে ভবরঞ্জন বাবুর ছত্রছায়ায় প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদার দীর্ঘ বছর ধরে এই দুর্নীতি ও অনিয়ম করে আসছেন। শিক্ষকতার নামে এমন নীতিহীন কর্মকান্ডকে তারা ভারতে টাকা পাচারের শামিল বলেও উল্লেখ করেন তারা।
অভিভাবকরা বলেন, রিঙ্কু ম্যাডাম সম্ভবত আর চাকরি করবেন না, তবে এতোবছর ধরে তিনি যে অন্যায়-অনিয়ম করেছে এর কোন শাস্তি হয়নি এবং তার ভগ্নিপতি শিক্ষা অফিসার ভবরঞ্জন বাবুরও কোন বিচার হয়নি।
এ ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলার সাবেক শিক্ষা অফিসার ভবরঞ্জন বাবু বলেন, আমি অনিয়ম করার এতো সুযোগ কাউকে দেইনি। আর আমি এখন ওই উপজেলায় দায়িত্বে নেই, তাই এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবো না।
চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রূপ কুমার দাস জানান, ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক মাসের মেডিক্যাল ছুটিতে যান প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদার। কিন্তু আজ (১৮ জুন) পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গ থেকে দেশে আসেননি। তিনি জানান, প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয় পরিচালনা, স্লীপের টাকা, উপবৃত্তি, কন্টিজেন্সিসহ যাবতীয় কাজ আটকে আছে। তিনি আরো জানান, ৮-৯ বছর ধরে এমন অনিয়ম চলছে। করোনার আগের বছরগুলোতেও তিনি ৫/৬ মাস পর পর দেশে এসে ৩/৪ দিন স্কুল করে জমে থাকা কাগজপত্রে সই দিয়ে আবার ভারত চলে যেতেন।
চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি রণলাল দাস বলেন, প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদারের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ। উপজেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসে দেয়া প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদারের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারটিতে একাধিকবার কল করলেও তার ওই নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সহকারী শিক্ষা অফিসার কামরুল হাসান জানান, জেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের নির্দেশে আজ আমি ওই বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছি। বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেছি প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদার উপস্থিত আছেন এবং তিনি গত ১ জুন থেকে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
কামরুল হাসান আরো জানান, ৩০ ডিসেম্বর রিঙ্কু মজুমদার এক মাসের মেডিক্যাল ছুটিতে যান। ছুটি শেষে তিনি কর্মস্থলে যোগদান না করায় তার বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোসলেহ উদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় আজ প্রধান শিক্ষক রিঙ্কু মজুমদারকে শোকজ করা হয়েছে। এতদিন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ২০২১ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর এবং ২০২২ সালের জানুয়ারী থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পান। এরআগে শিক্ষা অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন ভবরঞ্জন বাবু। তিনি কেন ব্যবস্থা নেননি, সেটা তিনি জানেন। আমি দায়িত্ব গ্রহনের পর গত ডিসেম্বর থেকে ওই প্রধান শিক্ষকের বেতন বন্ধ করে দিয়েছি।
নোয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি তার অজানা ছিল। গতকাল ঘটনাটি জানার পর উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে তদন্তপূর্বক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আজ (২১জুন) উপজেলা শিক্ষা অফিসার সরেজমিনে ঘটনার তদন্ত করিয়ে রিপোর্ট দিবেন।