জায়গা-জমি না থাকলেও লিলি আক্তারের দাম্পত্য জীবনে ছিল অফুরন্ত সুখ আর ভালবাসা। ছয় বছরের সংসারে জন্ম নেয় নিলয় আর লিজা নামের দুটি ফুটফুটে সন্তান। তাদের নিয়েই ছিল আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। হঠাৎ করেই দেড় বছর আগে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো লিলির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্বামী মো. মিজানের মৃত্যুতে চোখের পানিতে ভেসে যায় লিলির রঙ্গিন স্বপনগুলো। তার জীবনে নেমে আসে চরম দুঃসময়। লিলি ও তার দুই শিশু সন্তানের আশ্রয় হয় দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের ঝুঁপড়ি ঘরে। সেখানে থেকে কাঁথা সেলাই এবং অন্যের বাসা-বাড়িতে কাজ করে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সংসারের ঘøানি টানতে শুরু করেন লিলি। এতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন ২৭ বছরের টকবকে এই তরুণী।
হঠাৎ একটি খবর আসে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে গ্রামে শেখ হাসিনার উপহারের ঘর আসছে। ওই খবরে বুকভরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে নোয়াখালী সদর উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমির হোসেন বাহাদুরের কাছে গিয়ে ঘরের জন্য তালিকায় নাম লেখান লিলি।
সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে জেলার সদর উপজেলা প্রশাসনের তত্বাবধায়নে ভূমিহীন-গৃহহীন লিলি আক্তারের জন্য প্রস্তুত হয় পাকা ঘর। সেই ঘরে স্বপ্ন জয়ের যাত্রা শুরু করবেন এমন আশায় বেজায় খুশি লিলি।
সদর উপজেলার মুচাপুর গ্রামের মুসলিম মাঝি ব্যাপারী বাড়িতে অন্যের ঘরে বসবাস করা লিলি আক্তার তার জীবনের দুঃসময়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। অনেক কষ্টে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কাঁথা সেলাই এবং অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারের ঘøানি টানছি। জীবনে কখনো ভাবিনি নিজের জায়গা এবং পাকা ঘর হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মাথা গোঁজার ঠিকানা করে দিয়েছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, তাকে ধন্যবাদ। শেখ হাসিনার উপহারে আমার দুই শিশু সন্তান ভাসমান জীবনের লজ্জা থেকে রেহায় পাবে। আপন ঠিকানায় সাজাতে পারবো তাদের সুন্দর আগামীর দিনগুলো।
শুধু লিলি আক্তারই নয়, বছির থাকেন অন্যের বাড়িতে, সেলিম অন্যের জায়গায় আর খাসজমিতে থাকেন আবদুর রহিম। তাদের প্রত্যেকেরই ছিল না কোনো স্থায়ী ঠিকানা। প্রত্যেকের জীবনে ছিল লিলির মতো বুকফাটা বেদনার গল্প।
আগামী ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্যদিয়েই আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় পর্যায়ে নোয়াখালীর ৮টি উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের বাড়িতে পাকা ঘরে এবার মাথা গোঁজাবার ঠিকানা হচ্ছে এমন দুস্থ-অসহায় ৬৪৬ পরিবারের। এই ঘরে জীবনের গল্প পরির্বতনের পাশাপাশি ভাসমান জীবনের লজ্জা মুচে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সুবিধাভোগী পরিবারগুলো।
জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের এস.এ শাখার তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় পর্যায়ে নোয়াখালীতে মোট ঘর বরাদ্ধ হয় ২৩৬২টি। এরমধ্যে প্রথম ধাপে উপকারভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয় ৩৬৭টি ঘর। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২১ জুলাই সদর উপজেলায় ৩১২, বেগমগঞ্জে ৬০, কোম্পানীগঞ্জে ৪২, চাটখিলে ১০, সেনবাগে ৪২, সুবর্ণচরে ১৩৮, সোনাইমুড়িতে ২৭ ও কবিরহাটে ১৫টি ঘর উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে।
সদর উপজেলায় তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্ধ পাওয়া ৪৩৫টি ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে ৩১২টি ঘর। এরমধ্যে উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে ১৪টি, অশ^দিয়া ইউনিয়নের মুকিমপুরে ১৭টি, দক্ষিণ নাজিরপুরে ৮টি, এওজবালিয়ার দক্ষিণ চর শুল্লকিয়ায় ৪২টি, চর শুল্লুকিয়ায় ৬টি, পশ্চিম এওজবালিয়ায় ২৩টি, চরমটুয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে ৩৯টি, পূর্ব চরমটুয়া ইউনিয়নের সূর্য নারায়ণ বহর গ্রামে ৪৬টি, আন্ডারচর ইউনিয়নের পূর্ব মাইজচরা গ্রামে ৫৭টি, কালাদরাপ ইউনিয়নের রামহরিতালুক গ্রামে ১৩টি ও উত্তর চর শুল্লুকিয়া গ্রামে ৪৭টি নির্মাণাধীন ঘরে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করবে উপকারভোগীরা।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা কিনা একেবারেই দুস্থ, একেবারেই ভূমিহীন, স্বামী পরিত্যাক্তা-বিধবা নারী আছেন, প্রতিবন্ধী-ছিন্নমূল ব্যক্তি যারা আছেন, তাদেরকে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলোতে থাকার জন্য উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচন করেছি। তিনি বলেন, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টুনির যতগুলো প্রকল্প আছে, আমরা চেষ্টা করছি এই দুস্থ-অসহায় মানুষগুলোকে সেই প্রকল্পের আওতায় এনে তাদের আত্মসামাজিক অবস্থার উন্নতি যেন পাওয়া যায়। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন জমি ক্রয় করে হলেও ভূমিহীন-গৃহহীনদের ঘর করে দিতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা যে স্বপ্ন আমাদেরকে দেখিয়ে যাচ্ছেন, আমরা সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য সারথী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, তাঁর কন্যার নেত্রীত্বে ভূমিহীন-গৃহহীনদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো।